ডা: জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ রুমী:
সারা বিশ্বে চিকিৎসাপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও কিছু রোগ রয়েছে যা আমাদের জীবনে স্থায়ীভাবে ক্ষতি করতে পারে; এসব রোগ এবং রোগ দ্বারা সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা মাঝে মাঝে আমাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। আমরা মাঝে মাঝে দেখি, খুব হাসিখুশি কর্মঠ মানুষের কোনো একটি গুরুতর রোগ ধরা পড়ার পর তার কাজের গতি হারিয়ে ফেলেছেন এবং কাজের প্রতি তার অনীহা সৃষ্টি হয়েছে।
পারকিনসন’স ডিজিজ (সংক্ষেপে পিডি) এমন একটি রোগ যা ব্যক্তির ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং পেশাদার জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ডা: জেমস পার্কিনসন ১৯১৭ সালে প্রথম এই রোগটি সম্পর্কে ধারণা দেন এবং বলেন, এর ফলে মস্তিষ্কের কিছু অংশ ক্ষয় হয়ে যায় এবং কার্যকারিতা হারায়। এটি একটি নিউরোডিজেনারেটিভ ব্যাধি, যা প্রাথমিকভাবে রোগীর অঙ্গ নড়াচড়া করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র পিডি দ্বারা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, ধীরে ধীরে রোগীর জন্য চলাফেরা আরো বেশি কঠিন এবং পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিডির প্রাথমিক লক্ষণ হাঁটার সময় হাত ও পা কাঁপা। এরপর এটি ধীরে ধীরে মুখ এবং জিহ্বা নাড়ানোর ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, যার ফলে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হয়। আবার, কখনো কখনো এর ফলে ঘুমেরও সমস্যা হয়। ব্যক্তির চলাফেরার সামগ্রিক গতি সময়ের সাথে আরো কমে আসে। হাঁটার সময় প্রতিবার পা ফেলার দৈর্ঘ্য ছোট হতে থাকে। মাংসপেশি কঠিন ও শক্ত হয়ে যায় এবং চেয়ার বা বিছানা থেকে ওঠার সময় রোগী দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং আত্মবিশ্বাস বোধ করেন না। পিডি কখনো কখনো রোগীর কথা বলা বা হাসার ক্ষমতায়ও প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ আবার কথা বলার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং যথাযথ বিরতি না দিয়ে টানা কথা বলতে থাকেন।
পিডির মূল কারণ এখনো আবিষ্কার করা না গেলেও এর সম্ভাব্য কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। মস্তিষ্কের কিছু স্নায়ু কোষের (নিউরন) ক্ষতির ফলে ডোপামিন হ্রাস পায় এবং এর ফলে, মস্তিষ্কের কার্যক্রমে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। তেমন দেখা না গেলেও জেনেটিক মিউটেশন পিডির অন্যতম কারণ। যাদের পরিবারে কারো পিডি আছে, তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কয়েক ধরনের রাসায়নিক পিডি হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়, তাই, এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক কারখানার কর্মীরা আরো বেশি ঝুঁকির মুখে। পিডি হওয়ার সম্ভাব্য কিছু কারণের মধ্যে ‘লিউই বডিস’-কে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব বিষয়ে এখনো গবেষণা চলছে।
পিডি কেন হয় তা যেমন নির্দিষ্ট নয়, তেমনি কাদের পিডি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি সেটিও নির্দিষ্ট নয়। এটি কম বয়সীদের মধ্যে সাধারণত দেখা যায় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে পিডির ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। পরিসংখ্যান অনুসারে, নারীদের তুলনায় পুরুষদের পিডি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। যেসব কর্মী ভেষজনাশক এবং কীটনাশকের সংস্পর্শে আসে, তাদেরও পিডি হওয়ার ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যায়।
পিডির কারণে এমন অবস্থা হয় যে, দৈনন্দিন জীবনযাপনে রোগীকে লড়াই করতে হয়। এর মূল কারণ স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, যা ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের অন্যান্য সাধারণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলে। হতাশা, বিষণ্নতা ও অবসাদের প্রাথমিক লক্ষণ এবং এরপর বিশৃঙ্খল চিন্তা ও স্মৃতিভ্রংশ রোগ দেখা দেয়। কিছু রোগী খাবার খাওয়ার সময় অস্বস্তি বোধ করেন। তাদের মুখের ভিতরে অতিরিক্ত পরিমাণে লালা জমতে পারে, ফলে তাদের মুখ থেকে লালা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পিডি রোগীদের মধ্যে অনিয়মিত ঘুমের প্রবণতাও দেখা যায়। দিনের বেলা ঘুমিয়ে পড়া, খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা, ঘুমের মধ্যে বারবার জেগে ওঠা পিডির কারণে হতে পারে। কেউ কেউ তাদের মূত্রাশয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং অজান্তেই মূত্রত্যাগ করতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্য, অন্ত্রের চলাচল ব্যাহত হওয়া, উচ্চরক্তচাপ (অর্থোস্ট্যাটিক হাইপোটেনশন) পিডির কারণে হতে পারে।
পিডি সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলার চিকিৎসাপদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে, নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং পরিবার ও বন্ধুদের সহযোগিতায় যথাযথ পুনর্বাসনব্যবস্থা পিডি রোগীদের স্বাস্থ্য এবং স্থিতিশীলতার জন্য উপকারী বলে প্রমাণিত। ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন (ডিবিএস) পিডির অস্ত্রোপচারের অন্যতম প্রচলিত পদ্ধতি। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে পিডি আছে এবং জড়তা ও কাঁপার প্রবণতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা রয়েছে, এমন বেশির ভাগ রোগীকে ডিবিএস-এর সুপারিশ করা হয়। ১ ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় গতিবিধি স্টিমুলেট করার জন্য, ডিবিএসে রোগীর মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রোড বসানো হয়। অস্ত্রোপচারটি তেমন পীড়াদায়ক নয়, এবং একদল নিউরোস্পেশালিস্টের সাথে বিশেষজ্ঞ নিউরোসার্জন এটি সম্পাদন করে থাকেন। ডিবিএস সার্জারির পরে বিভিন্ন রোগী বিভিন্ন বিষয়ের হয়ে থাকেন, তবে রোগীরা সাধারণত কয়েক মাসের মধ্যেই এ বিষয়গুলোতে অভ্যস্ত হয়ে যান। রোগীর অভিজ্ঞতা এবং প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে ডিভাইস সেটিংস সামঞ্জস্যপূর্ণ করা প্রয়োজন, তাই রোগীকে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগে থাকতে হবে এবং রোগী কিভাবে কৃত্রিম স্টিমুলেশনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন, তা চিকিৎসককে কোনো দ্বিধা ছাড়াই জানাতে হবে।
কারো যদি পিডি হচ্ছে বলে সন্দেহ হয়, তবে অনতিবিলম্বে তাকে একজন নিউরোলজিস্টের কাছে নেয়া উচিত। চেকআপ এবং রোগীর চিকিৎসা ও পারিবারিক ইতিহাস বিশ্লেষণের পরে, একজন নিউরোলজিস্ট নির্ধারণ করতে পারবেন রোগীর পিডি হয়েছে কি না। তবে, যেহেতু পিডির প্রকৃত কারণ এখনো অজানা, তাই সঠিকভাবে পিডি নির্ণয় বা এর সম্পূর্ণ চিকিৎসা করা বেশ কঠিন। রোগীর এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সেবাদাতার সামগ্রিক সেবাদান পদ্ধতির পাশাপাশি রোগীর আরোগ্য লাভের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে সাধারণত পিডির ঝুঁকি কমানো যায়। ফিজিওথেরাপি পিডির ফলে সৃষ্ট জটিলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার আরেকটি উপায় হতে পারে।
অসুখবিসুখ নিতান্তই অপ্রত্যাশিত এবং এটি আমাদের জীবনে অবাঞ্ছিত জটিলতা তৈরি করে থাকে। পিডি রোগীরা একটা সময় পরে বিচ্ছিন্ন এবং বদমেজাজি আচরণ করতে পারেন। তবে, নিকটাত্মীয় এবং বন্ধুবান্ধবকে সবসময় মনে রাখতে হবে, রোগীর মস্তিষ্কের শতভাগ সঠিকভাবে কাজ করছে না। তাই, রোগীদের কাজের জন্য সমালোচনা এবং প্রশ্ন না করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত এবং তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত।
সতর্কীকরণ : ‘বিবৃত প্রতিটি তথ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের (এনআইএনএস) সহকারী অধ্যাপক ডা: জালাল উদ্দীন মোহাম্মদ রুমীর নিজস্ব মতামত, যার উদ্দেশ্য সর্বসাধারণের মধ্যে তথ্য সঞ্চার ও সচেতনতা সৃষ্টি করা।’
তথ্যসূত্র : https://www.parkinson.org/Understanding-
Parkinsons/ Treatment/ Surgical-Treatment-Options/Deep-Brain-Stimulation
লেখক : সহকারী অধ্যাপক (নিউরোসার্জারি)
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল (এনআইএনএস)